কুয়াকাটায় নির্মাণাধীন সড়ক লন্ডভন্ড: প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগে তদন্ত কমিটি গঠন

পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতের জিরোপয়েন্ট সংলগ্ন সদ্য নির্মাণাধীন সড়কটি বঙ্গোপসাগরের অস্বাভাবিক জলোচ্ছ্বাসে ব্যাপকভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে। বৃহস্পতিবার (৩০ মে) বেলা ১১টা থেকে প্রায় দেড়টা পর্যন্ত চলে ভয়াবহ জোয়ার ও ঢেউয়ের তাণ্ডব। এই ঘটনায় নতুন নির্মিত সড়কের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ অংশ সাগরে বিলীন হয়ে যায়। এর ফলে স্থানীয়দের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি ভাইরাল হয়ে পড়ে।
স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করছেন, অত্যন্ত নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী, প্রকৌশলগত ত্রুটি ও তদারকির অভাবে সড়কটি নির্মাণের কয়েক মাসের মধ্যেই ধসে পড়ে। অনেকেই এ ঘটনাকে 'ব্যর্থ উন্নয়ন প্রকল্পের ফল' হিসেবে আখ্যায়িত করছেন এবং দায়ীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি তুলেছেন।
গঠিত হলো তদন্ত কমিটি
ঘটনার প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. রবিউল ইসলাম পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। কুয়াকাটা পৌরসভার প্রশাসক ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ ইয়াসীন সাদেককে আহ্বায়ক করে গঠিত কমিটিতে আরও রয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড কলাপাড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপজেলা প্রকৌশলী, এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলী এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা।
তদন্ত কমিটিকে আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট প্রদান করতে বলা হয়েছে। ইউএনও জানান, “তদন্ত কমিটির মতামতের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বিষয়টি আমরা গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি।”
নিম্নমান ও অনিয়মের অভিযোগ
তদন্ত কমিটির গঠনের আদেশপত্রে বলা হয়েছে, “নির্মাণাধীন রাস্তাটি অত্যন্ত নিম্নমানের উপকরণ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। স্থানীয় বালু ও পাতলা সিসি ঢালাই ব্যবহার করে কাজ শেষ করার চেষ্টা করা হয়। প্রকল্প হাতে নেওয়ার আগে সম্ভাব্যতা যাচাই না করায়, সমুদ্রসীমার ঢেউয়ের উচ্চতা বা জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকি বিবেচনায় আনা হয়নি।”
এছাড়া অভিযোগ রয়েছে, নির্মাণ প্রকল্পের পরিকল্পনায় জনগণের মতামত উপেক্ষিত হয়েছে এবং গণমাধ্যম ও প্রশাসনের বারবার উদ্বেগ সত্ত্বেও প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেননি।
সাবেক মেয়রের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ
স্থানীয়রা অভিযোগ করছেন, প্রকল্পটি সাবেক মেয়র আনোয়ার হাওলাদারের ব্যক্তিগত স্বার্থসংশ্লিষ্ট ছিল এবং তিনি কোনো সরকারি টেন্ডার প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে আত্মীয়স্বজনকে দিয়ে কাজ শুরু করিয়েছেন। প্রকল্পের মোট বরাদ্দ প্রায় চার কোটি টাকা বলে জানা গেছে। তিনটি প্যাকেজে বিভক্ত এই সড়ক প্রকল্পে প্রথম পর্যায়ে প্রায় ১৩০০ মিটার কাজ শেষ হলেও বাকি ৭০০ মিটার কাজ শুরুই হয়নি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে স্থানীয় নাগরিক কেএম বাচ্চু লেখেন, “এই ধরনের ব্যর্থ উন্নয়ন প্রকল্পের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।”
সাবেক মেয়রের দাবি
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে সাবেক মেয়র আনোয়ার হাওলাদার বলেন, “প্রকল্পটি নিয়মতান্ত্রিকভাবে টেন্ডারের মাধ্যমে অনুমোদনপ্রাপ্ত। বর্তমানে সিসি ঢালাইয়ের কাজ চলছিল। এরপর আরসিসি কাজ এবং গাইডওয়াল নির্মাণ হওয়ার কথা ছিল, যা ঢেউ ঠেকানোর জন্য অত্যাবশ্যকীয়। বিল সংক্রান্ত বিষয় প্রকৌশলীরাই ভালো বলতে পারবেন।”
তবে একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানিয়েছে, প্রকল্পের আওতায় ঠিকাদারকে ইতোমধ্যে প্রায় ৬৩ লাখ টাকা বিল প্রদান করা হয়েছে।
প্রকৌশলীদের নিরবতা ও প্রশাসনের আশ্বাস
এই সড়ক নির্মাণে দায়িত্বপ্রাপ্ত কুয়াকাটা পৌরসভার সহকারী প্রকৌশলী নিয়াজুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। ফলে প্রকৌশল বিভাগের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো ব্যাখ্যা এখনো পাওয়া যায়নি।
তবে কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. রবিউল ইসলাম বলেন, “সড়ক বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেলে দোষীদের চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
কুয়াকাটা বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত একটি জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র। এখানকার সমুদ্রসৈকত দেশের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে পরিচিত। তবে প্রতিনিয়ত জোয়ার-ভাটা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে এখানকার অবকাঠামো ঝুঁকির মধ্যে থাকে। এ অবস্থায় তাড়াহুড়ো করে নিম্নমানের সড়ক নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।