
উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে দুর্নীতি বন্ধে সচিবদের কঠোর হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
নিজ নিজ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অসঙ্গতি, অনিয়ম ও অবহেলা দূর করতে পদক্ষেপ নিতে বলেছেন। এছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতার লক্ষ্যে কেনাকাটা কার্যক্রমে যথাসম্ভব উন্মুক্ত টেন্ডার আহ্বান করার নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কোনোভাবেই অনিয়ম-দুর্নীতি টলারেন্স করা হবে না। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
বুধবার শেখ হাসিনা সচিব সভায় এসব নির্দেশনা দেন। প্রধানমন্ত্রী তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে সভায় অংশগ্রহণ করেন। সচিবেরা রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের পরিকল্পনা বিভাগের এনইসি সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত এ সভায় সশরীরে অংশ নেন।
সভায় সরাসরি ১৩টি এজেন্ডা নিয়ে আলোচনা হয়। অসুস্থ থাকায় একজন ছাড়া সব সচিব এ সভায় অংশ নেন। এতে বক্তব্য রাখেন ১৭ জন সচিব। পরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম এ বিষয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেন। তিনিই সচিব সভা পরিচালনা করেন।
সভায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সুবিধাজনক সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া, করোনা পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম, ২১ কোটি ৪ লাখ ডোজ টিকা পাওয়ার প্রতিশ্রুতি, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
তিনি জানান, এছাড়াও নির্বাচনি ইশতেহার বাস্তবায়ন, সামাজিক নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক বাড়ানো, সরকারি ব্যয় কমানো, বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বাড়ানো ও বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের বিদ্যমান উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে সরকারের নেওয়া পরিকল্পনাগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়নে সচিবদের নির্দেশ দেন।
তিনি বলেন, আমাদের প্রেক্ষিত-পরিকল্পনা বা ডেল্টা প্ল্যান মাথায় রেখে নেওয়া উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন যেন যথাযথভাবে হয়। কেননা, আমাদের একটাই লক্ষ্য তৃণমূল পর্যায়ের মানুষগুলো যেন উন্নত জীবন পান। তারা যেন দারিদ্র্যের হাত থেকে মুক্তি, অন্ন-বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসার সুযোগ পায়। বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে ভবিষ্যতেও যেন একইভাবে এগিয়ে যেতে পারে, সেভাবে আমাদের কার্যক্রম চালাতে হবে।
সভায় সরকারি কাজে স্বচ্ছতা বজায় রাখা এবং অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধে সচিবদের ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন সরকার প্রধান। প্রধানমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, কোনোভাবে দুর্নীতি টলারেন্স করা হবে না। যার সেক্টরের বিষয় সেই দেখবেন।
প্রধানমন্ত্রী নিজেও পয়েন্ট আউট করে বলেছেন- এসব দেখা সচিবদের দায়িত্ব। সচিবরাই হলেন প্রিন্সিপাল অ্যাকাউন্টিং অফিসার। সুতরাং ইমোরাল প্র্যাকটিস, মিসইউজ ও অবহেলা হয়- এসবই প্রত্যেক সচিবকে দেখতে হবে। এছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) কাজ করবে।
প্রধানমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে তিনি আরও বলেন, ফাইন্যান্সিয়াল রুলস-রেগুলেশন আমরা মানতেছি। এটা আরও কঠোরভাবে মানতে হবে। যথাসম্ভব ওপেন টেন্ডার পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। স্পেশাল হলে সেটা ভিন্ন কথা। পিপিআরে সেই বিষয়েও বলা আছে।
সচিব বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সরকারি ব্যয় কমাতে হবে, ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্প সুদে বিভিন্ন ঋণ ব্যবস্থা প্রবর্তন করার কথা বলেছেন। যাতে ছোট ও মাঝারি সবার বিনিয়োগ ঠিক থাকে। আর সামাজিক নিরাপত্তা নেটওয়ার্কের কাজ যেন আরও বিস্তৃত করা হয়।
যাতে গরিব-অসহায় মানুষের সুবিধা হয়। ২০২৬ সালের পর কোটামুক্ত বাণিজ্যের সুবিধা কমে গেলে কিভাবে চলব সে বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কারণ তখন জিএসপি থাকছে না। এক্ষেত্রে নিজেদেরই সুবিধা ওপেন করতে হবে। যাতে বিনিয়োগকারীরা আরামদায়কভাবে বিনিয়োগ করতে পারেন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা প্রসঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে সভায় বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। আলোচনার পর প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সুবিধাজনক সময়ে স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়া হবে। সেজন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিকল্পনা করছে। পাশাপাশি আমাদের সরকারি স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম অনলাইন বা ডিজিটাল সিস্টেমেও চলবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে শিক্ষা কার্যক্রম পুরোপুরি ডিজিটালি চলছে এবং গ্র্যাজুয়েশনও হয়ে যাচ্ছে।
সভায় শিক্ষা সচিবও বলেছেন তারা একটা পরিকল্পনা করছেন। মঙ্গলবার তারা আইসিটি বিভাগের সঙ্গে বৈঠকও করেছেন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে যারা আছেন তাদের দ্রুত টিকা দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, খুব দ্রুতই আমরা ৬ কোটি টিকা পেয়ে যাচ্ছি। বিভিন্ন গ্রুপ করে ছাত্রদের মধ্যে যারা বয়সের সীমানার মধ্যে আসবে তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা দেব।
সেপ্টেম্বরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সভায় দুটো জিনিস দেখার কথা বলা হয়েছে- জেনারেল সিনারিও যদি কমফোর্টেবল অবস্থায় চলে আসে, ভাইরাস যদি নিয়ন্ত্রণে আসে এবং দুই নাম্বার হলো ভ্যাকসিনেশন। দুটো জিনিস বিবেচনা করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে বলেছেন। সব সচিব এবং প্রধানমন্ত্রী নিজেও বলেছেন-ছেলেমেয়েরা বাসায় বসে থাকতে থাকতে অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে আছে। সুতরাং তাদের তো বাইরে নিয়ে আসা দরকার।
স্বাস্থ্যসেবার বিষয়ে খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, স্বাস্থ্যসেবা ও কোভিড ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সভায় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ জানিয়েছে-বিভিন্ন উৎস থেকে ২১ কোটি চার লাখ ডোজ টিকার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। ৩ কোটি ১০ লাখ ডোজ আমরা কিনেছি। এর মধ্যেই ২ কোটি ৫ লাখ টিকা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন ১ কোটি ৪ লাখ হাতে আছে। ধাপে ধাপে সেগুলো দেওয়া হচ্ছে।
খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের নির্দেশনা দেওয়া হয় সভায়। এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, খাদ্যের অবস্থা ওই মন্ত্রণালয়ের সচিব প্রধানমন্ত্রীর সামনে তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়কে বসে সমন্বয় করতে বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমাদের উৎপাদন কত, চাহিদা কত, সেই অনুযায়ী প্রয়োজন পড়লে আমদানি করব।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, সরকারের নির্বাচনি ইশতেহার আমার গ্রাম আমার শহর, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স, তারুণ্যের শক্তি, নারীর ক্ষমতায়ন, শিশুর কল্যাণ, জেন্ডার সমতা, নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা, সন্ত্রাস সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ নির্মূলের বিষয়গুলো পর্যালোচনা করা হয়েছে।
ব্রিফিংয়ের একপর্যায়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব পদ্মা সেতুতে বারবার ফেরির আঘাত লাগার বিষয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, পদ্মাতে হঠাৎ করে এমন কারেন্ট (স্রোত) সৃষ্টি হয় যে ওই সময় কারও পক্ষে ফেরি কন্ট্রোল করা সম্ভব নয়। অনেক সময় মাস্টার নির্দিষ্ট রুট ফলো করেন না। তিনটি ঘটনা ঘটেছে রুট ফলো না করার কারণে। তিনি বলেন, চালকের অবহেলা ছিল, যার কারণে তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেওয়া হয়েছে।
দৈনিক চাঁদনী বাজার / সাজ্জাদ হোসাইন