রোহিঙ্গা স্বামীর প্রতারণায় বাঙালি নারীর ২৬ দিন কারাভোগ

বাঙালি নারী সিরাজ খাতুন (৩৩)। প্রেমের টানে পালিয়ে বিয়ে করেছিলেন রোহিঙ্গা যুবক সিদ্দিক আহমদকে। ভাতা পাওয়ার লোভে সিরাজকে রোহিঙ্গা হিসেবে ক্যাম্পে নিবন্ধন করেন স্বামী। কিন্তু একপর্যায়ে স্বামীর নির্যাতনে ক্যাম্প ছেড়ে আবার বাবার বাড়িতে চলে আসেন সিরাজ। এরই মধ্যে গত ৩ জুন বিদেশ যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট করাতে গেলে তার আঙুলের ছাপ রোহিঙ্গাদের তালিকার সঙ্গে মিলে যায়। এরপর গ্রেফতার হয়ে কারাগারে যান।
অবশেষে নানা আইনি প্রক্রিয়া শেষে দীর্ঘ ২৬ দিন পর মঙ্গলবার (২৯ জুন) সকাল ১০টার দিকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্ত হন সিরাজ খাতুন।
আদালত ও মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, সিরাজ খাতুন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পূর্ব খুরুশিয়া গ্রামের মৃত নুর ইসলামের মেয়ে। জাতীয় পরিচয়পত্রসহ বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে তার যাবতীয় কাগজপত্র আছে। এক দশক আগে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা যুবক সিদ্দিক আহমদের প্রেমে পড়েন তিনি। এরপর তাকে পালিয়ে বিয়েও করেন। বাঙালি হয়েও বিয়ের পর রোহিঙ্গা স্বামীর সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে বসবাস করতে থাকেন ওই নারী।
একপর্যায়ে ২০১৮ সালে আটকের পর এই দম্পতিকে টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাঠায় পুলিশ। এরপর ভাতা পাওয়ার লোভে তার সিরাজ খাতুনকে ‘রোহিঙ্গা’ হিসেবে ক্যাম্পে নিবন্ধন করেন তার স্বামী। সিরাজ খাতুনের নাম সালমা খাতুন দিয়ে বাবার নাম উল্লেখ করা হয় মো. ইসহাক। ঠিকানা দেয়া হয় মিয়ানমারের।
এরই মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহ শুরু হয়। সিরাজ ও সন্তানদের নির্যাতন করতে থাকে তার স্বামী। নির্যাতনে তাদের তিন সন্তানের একজন মারা যায়। এরপর রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে পালিয়ে রাঙ্গুনিয়ায় এসে বসবাস করতে থাকেন ওই নারী।
এরপর আত্মীয়স্বজনের পরামর্শে ওমানে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন সিরাজ। এজন্য গত ৩ জুন চট্টগ্রাম বিভাগীয় অফিসে পাসপোর্ট করাতে যান তিনি। সেখানেই বাধে বিপত্তি। পাসপোর্ট অফিসে সিরাজ খাতুনের আঙুলের ছাপ যাচাই করে দেখা যায়, ২০১৮ সালে তিনি ‘সালমা খাতুন’ নামে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিবন্ধিত হয়েছেন। এরপর তাকে ৯ মাসের শিশুসন্তানসহ নগরের ডবলমুরিং থানায় মামলা করে পুলিশের হাতে তুলে দেয় পাসপোর্ট অফিস।
সেখান থেকে পুলিশ পরদিন (৪ জুন) তাকে সংশ্লিষ্ট মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে পাঠায়। ওইদিন আদালত সিরাজ খাতুনকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
সবকিছু জেনে সিরাজ খাতুনের পক্ষে আইনি লড়াইয়ে নামেন চট্টগ্রামের মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট জিয়া হাবীব আহসান। তিনি গত ১৬ জুন আদালতে সিরাজ খাতুনের পক্ষে জামিন আবেদন শুনানি করেন। শুনানিতে সিরাজ খাতুনের বাংলাদেশি নাগরিকত্বের যাবতীয় প্রমাণপত্র উপস্থাপন করা হয়। এরপর চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শফি উদ্দিনের আদালত স্থানীয় সংসদ সদস্যের (এমপি) জিম্মায় তাকে জামিন দেন।
কিন্তু ওই সময় জাতীয় সংসদের অধিবেশন চলায় স্থানীয় এমপি ড. হাছান মাহমুদের সাক্ষাৎ পেতে দেরি হয়। এ কারণে আদালতে অন্য কারও জিম্মায় জামিন পেতে আরেকটি আবেদন করা হয়। আবেদনটি গত ২০ জুন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মেহনাজ রহমানের আদালতে শুনানি হয়। শুনানি শেষে এবার আদালত স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যানের জিম্মায় তার জামিনের আদেশ দেন।
এরপর সিরাজ খাতুনের স্বজনরা রাঙ্গুনিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা স্বজন কুমার তালুকদারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি নিজে জামিন সংক্রান্ত কাগজপত্রে সই করার আগে স্থানীয় ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও ওয়ার্ড মেম্বরের সই নেয়ার অনুরোধ করেন। তার কথামতো চেয়ারম্যান ও মেম্বরের সই নেয়া হয়। এরপর আবার তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এবার আদালতের আদেশের কপি ছাড়া স্বাক্ষর করবেন না বলে জানান। সবশেষ আদালতের আদেশের কপিসহ গতকাল (সোমবার) উপজেলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জিম্মা নেন।
এর পরিপ্রেক্ষিতে মঙ্গলবার সকালে সিরাজ খাতুন কারামুক্ত হন।
এ বিষয়ে সিরাজ খাতুনের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জিয়া হাবীব আহসান বলেন, ‘বাঙালি নারী হয়েও রোহিঙ্গা স্বামীর প্রতারণার কবলে পড়ে সিরাজ খাতুন দীর্ঘ ২৬ দিন কারাভোগ করেছেন। নির্দিষ্ট আইনি প্রক্রিয়া শেষে আজ (মঙ্গলবার) তিনি কারামুক্ত হয়েছেন। আমরা তার মামলা খালাসের জন্য আবেদন করব। পাশাপাশি যাদের প্রতারণায় তিনি মিথ্যা মামলায় কারাভোগ করেছেন আমি তাদের শাস্তি দাবি করছি। এছাড়াও মাত্র নয় মাসের বাচ্চাসহ তিনি কারাভোগ করার বিষয়টি নিয়ে আদালতের কাছে ক্ষতিপূরণের আবেদন করব।’
দৈনিক চাঁদনী বাজার / সাজ্জাদ হোসাইন