প্রকাশিত : ২ জুলাই, ২০২৫ ০১:৪২

হাসিনা আগেরদিন পলাইলে, আমার ব্যাটা বাইচ্যা থাকত: শহীদ সুমনের মা

ফিরোজ আল আমিন, চলনবিল, সিরাজগঞ্জঃ
হাসিনা আগেরদিন পলাইলে, আমার ব্যাটা বাইচ্যা থাকত: শহীদ সুমনের মা

‘ব্যাটার লাশ আগের দিন দিল না, পরের দিন লাশ পাইলাম, খবর পাইল্যাম হাসিনা পালাইছে। হাসিনা যদি আগের দিন পালাইতো তাইলে আমার ব্যাটা বাইচা থাকত।’— এই কথাগুলো বলছিলেন সিরাজগঞ্জের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহত সুমন শেখের মা ফিরোজা বেগম। সুমনের মৃত্যুর ১০ মাস ২৪ দিন পরও সেই ভয়াবহ দিনটি একবুক ক্ষোভ ও শোকের সঙ্গে স্মরণ করে যাচ্ছেন তিনি।

ফিরোজা বেগম তার ছেলে সুমনের হত্যার পর প্রতিটি দিন একে একে গুণছেন। ৪ আগস্ট, ২০২৪-এ ঘটনার দিন তিনি সকালে সুমনের জন্য বাজারে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সুমন তার বাবার দোকানে গিয়ে ১০ টাকা নিয়েছিল এবং কিছু সময় পরে বাড়িতে ফিরে আসে। ফিরোজা বলেন, "আমি ঘুমাচ্ছিলাম, সুমন আমাকে ডাকছিল কিন্তু আমি শুনতে পাইনি। পরে আমি এক ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখি এবং বাইরে এসে শুনি সুমনের গুলি লেগেছে। আমি দৌড়ে হাসপাতালে গেলাম, কিন্তু গিয়ে দেখি সুমন আর নেই।"

ফিরোজা আরও বলেন, "সুমন ছিল খুব ভালো ছেলে, সবাইকে ভালোবাসত। প্রতিদিনই তার জন্য আমি ও তার বাবা কান্না করি। আমার ছেলে চলে যাওয়ার পর আমরা সবাই শোকের মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছি।"

সুমনের বাবা গনজের আলী (৫৯) জানালেন, সুমন তার জীবনের সবচেয়ে বড় সহায় ছিল। চায়ের দোকান দিয়ে যে আয় হতো, তা দিয়ে সংসার চালানোর জন্য সুমন তার আয়ে সাহায্য করত। তিনি বলেন, "৪ আগস্ট সুমন সকালে ১০ টাকা নিয়ে যায় এবং আমাকে না জানিয়ে মিছিলে যোগ দেয়। দুপুর ১১টার দিকে খবর পাই সুমন গুলিবিদ্ধ হয়েছে।"

সুমনের ছোট বোন আদুরী খাতুন বলেন, "আমাদের পরিবার খুবই গরিব ছিল, ভাই কখনও আমার পড়াশোনা চালানোর জন্য নিজেকে ত্যাগ করেছে। সে ভালো জায়গায় পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়ে ভর্তি হয়নি, কারণ সে চেয়েছিল আমার পড়াশোনা চালু থাকুক।"

এদিকে, সুমনের মৃত্যুতে তার পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। সুমনের পরিবারকে জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ টাকা, বিএনপি থেকে দেড় লাখ টাকা, জামায়াত থেকে ২ লাখ টাকা, এবং আরও নানা সাহায্য সহ ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র, দুটি গরু ও একটি অটোরিকশাও দেওয়া হয়েছে।

সুমনের হত্যাকাণ্ডের তদন্তকারী কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. শরিফুল ইসলাম জানান, "এ পর্যন্ত সাবেক সংসদ সদস্য জান্নাত আরা হেনরী ও সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শামীম তালুকদারসহ বেশ কয়েকজন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যান্য আসামিদের গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে।"

সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান বাচ্চু বলেন, "সুমন ছাত্রদলের একজন নিবেদিত কর্মী ছিল। সে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশ নিয়ে শত্রুদের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে। আমরা সুমনসহ নিহত ১১ জন শহীদের হত্যার বিচার চাই।"

সুমনের জীবন:
সুমন শেখ ১৯৯৩ সালের ২ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ শহরের গয়লা দক্ষিণপাড়া মহল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা গনজের আলী চায়ের দোকান পরিচালনা করতেন। সুমন সংসারের খরচ মেটানোর জন্য পড়াশোনা করার পাশাপাশি কাজ করতেন। সিরাজগঞ্জ সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর সুনামগঞ্জ পলিটেকনিকে ডিপ্লোমা পড়ার সুযোগ পেলেও সেখানে ভর্তি হননি।

৪ আগস্ট, ২০২৪ সালে সুমন সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনে সিরাজগঞ্জ শহরে ছাত্র-জনতার মিছিলে যোগ দেন। মিছিলটি ইলিয়ট ব্রিজের কাছে পৌঁছালে যুবলীগের নেতাকর্মীরা গুলি চালায়। সুমনের বুকের পাঁজরের নিচে তিনটি গুলি লাগে, এবং তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেও চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

বিচার দাবি:
সুমনের পরিবার এবং স্থানীয়রা হত্যাকারীদের বিচার দাবি করছেন। ছাত্রদলও সুমনের হত্যার জন্য দোষীদের শাস্তির দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে।

উপরে